খেতের আলু তোলা ও গম মাড়াই শেষ হয়েছে বেশ কয়েকদিন হলো। খেতের বোরো ধান পাকতে আরও মাস দেড়েক বাকি। ফলে উত্তরের কৃষি শ্রমিকদের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। এখন রাজশাহী ও খুলনার বিভিন্ন জেলা-উপজেলাগুলোতে শুরু হয়েছে নতুন ধানকাটার উৎসব, চলছে মাড়াই। ধান কাটা, মাড়াই করে শুকানোর পর গোলায় তুলে রাখতে কৃষকেরা খুব ব্যস্ত। এ কারণে কাজের সন্ধানে পরিজন ছেড়ে উত্তরের কৃষিশ্রমিকেরা হাতে বাঁশের বাংকুয়া (ভার), মাথাইল, কাস্তে আর পিঠে ব্যাগ নিয়ে দলবেঁধে ছুটছেন ওই সব এলাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোরো মৌসুমে প্রতিবারের মতো এবারও চাষিরা কৃষিশ্রমিকের সংকটে রয়েছেন। বিশেষ করে জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, সান্তাহার, আদমদীঘি, আত্রাই, নওগাঁ, নাটোর, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এ সংকট রয়েছে। তাই উত্তরের হাজার হাজার কৃষিশ্রমিক কাজের সন্ধানে ট্রেনে, বাসে ও খোলা পিকআপে চড়ে ওই সব এলাকায় ছুটছেন। প্রতিদিন সকালে নীলফামারীসহ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দর, রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার দিনমজুরেরা ভিড় করছেন উত্তরের রেলস্টেশনগুলোতে। বিশেষ করে চিলাহাটি, ডোমার, নীলফামারী ও সৈয়দপুরে রেলস্টেশনে কৃষিশ্রমিকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
নীলফামারী রেলস্টেশনে খুলনাগামী রকেট মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের বটতলী এলাকার কৃষিশ্রমিকের সর্দার দুলাল হোসেন। তিনি বলেন, গ্রামের ১০ জনের একটি দল নিয়ে ধান কাটতে যাচ্ছি বগুড়ার সান্তাহারে। ওই এলাকায় প্রতিবছর ধান কাটতে যাই। ওখানকার গৃহস্থদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। মাঠে ধান পাকলে মোবাইল ফোনে আমাদের ডেকে নেয় সেখানকার গৃহস্থরা। ডোমারের জোড়াবাড়ি এলাকার কৃষি শ্রমিক সুজন ইসলাম বলেন, বাবা-মা ও সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে অর্থের আশায় রোজগার করতে যাচ্ছি। আমার বাবা-মা বৃদ্ধ মানুষ। সেই সঙ্গে আমার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালাতে কাজ করতে হয়। এখনও এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়নি। তাই দু-পয়সা উপার্জন করতে অন্যান্যদের সঙ্গে আমিও কাজের সন্ধানে যাচ্ছি।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার রামকলা গ্রামের কৃষিশ্রমিক জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, কাজ না থাকায় প্রায় এক মাস থেকে বসে আছি। অল্প পুঁজি ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এবারে আমার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেয়ের জন্য নতুন জামা-কাপড়, জুতা ও পরীক্ষাকেন্দ্রে যাতায়াতের খরচ চালাতে হয়েছে। তাই পরিবারে সদস্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর দাদন ব্যবসায়ীর টাকা পরিশোধ করার জন্য গ্রামের অন্য কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে নাটোর জেলায় ধান কাটতে যাচ্ছি। গত বছর নওগাঁর আত্রাইয়ে ধান কাটতে গিয়েছিলাম। চুক্তিভিত্তিক ধান কাটতে গিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। রাতে থাকা ও তিনবেলা খাবার গৃহস্থরা বহন করায় ভালো উপার্জন হয়। এদিকে অনেকে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করার পরেও যাত্রীদের ভিড়ে ট্রেনে উঠতে পারছেন না। তাই বিকল্প পথে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে গন্তব্যে যাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুরের কৃষিশ্রমিক মেহের আলী বলেন, টিকিট কাটতে আইডি কার্ড লাগে, তা জানতাম না। তবে আসন ছাড়া টিকিট সংগ্রহ করতে পেরেছি খুলনাগামী ‘রূপসা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের। কিন্তু যাত্রীদের ভিড়ের চাপে ওই ট্রেনে উঠতে পারিনি। পরে স্টেশন কর্তৃপক্ষ মানবিক দিক বিবেচনা করে পরবর্তী ট্রেনে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন।সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার ওবাইদুল ইসলাম রতন বলেন, তিন-চার দিন ধরে খুলনা ও রাজশাহীগামী ট্রেনগুলোতে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো উত্তরের জেলা থেকে কৃষিশ্রমিকেরা ছুটছেন দক্ষিণাঞ্চলে। আসনের কয়েক গুণ বেশি আসন ছাড়া টিকিট বিক্রি হচ্ছে। কৃষিশ্রমিকদের সংকট লাঘবে এবং গৃহস্থরা দ্রুত মাঠের ধান যেন ঘরে তুলতে পারেন-এ কথা মাথায় রেখে আসনবিহীন টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। তবে কেউ যাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি রেলওয়ে পুলিশ সজাগ রয়েছে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন